পাহাড়ে পর্যটকদের মৃত্যু : কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

abc

পাহাড়ে পর্যটকদের মৃত্যু, বিশেষ করে ঝর্ণা বা পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান, যা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।

মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণসমূহ

অপ্রস্তুত ও অনভিজ্ঞ পর্যটক : অনেক পর্যটক পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া পাহাড়ের চ্যালেঞ্জিং জায়গায় ঘুরতে যায়। সেখানকার ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া সম্পর্কে তাদের ধারণা কম থাকে।

অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ : পাহাড়ি এলাকায় আকস্মিক বৃষ্টিপাত বা পাহাড়ি ঢল একটি সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ঝর্ণা বা ঝিরিপথে পানির স্রোত হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে, যা অনেক সময় জীবনঘাতী হয়ে ওঠে।

তথ্যের অভাব : অনেক সময় পর্যটকরা স্থানীয় আবহাওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে বঞ্চিত হন। ট্যুর অপারেটররাও অনেক সময় সঠিক তথ্য সরবরাহ করেন না বা ঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে অবগত করেন না।

নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি : দুর্গম ঝর্ণা বা ট্রেকিং রুটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। বিপদাপন্ন স্থানে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড, গাইডলাইন বা জরুরি সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রায়শই অনুপস্থিত।

ঝুঁকিপূর্ণ স্থান : অনেক সময় অনভিজ্ঞ ট্যুর অপারেটর এবং স্থানীয় গাইডরা পর্যটকদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যান, যেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো সক্ষমতা থাকে না।

অতি-উৎসাহ ও অসাবধানতা : অনেক পর্যটক অতি-উৎসাহের বশে বা অসাবধানতাবশত বিপজ্জনক কাজ করেন, যেমন- স্রোতের কাছাকাছি যাওয়া, গভীর পানিতে নামা বা পিচ্ছিল পাথরে হাঁটা।

যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা : দুর্গম এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের দুর্বলতা বা অপ্রাপ্যতার কারণে জরুরি মুহূর্তে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা উদ্ধার কার্যক্রমকে বিলম্বিত করে।

প্রতিরোধের উপায় ও সুপারিশ

পাহাড়ে পর্যটকদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধ করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে;
পর্যটকদের সচেতনতা বৃদ্ধি : ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করতে হবে। প্রত্যেক পর্যটককে ভ্রমণের আগে স্থানীয় ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া এবং জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে জেনে নিতে উৎসাহিত করতে হবে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার : ঝুঁকিপূর্ণ ঝর্ণা বা ট্রেকিং রুটে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড স্থাপন করতে হবে, যেখানে ঝুঁকির মাত্রা এবং জরুরি যোগাযোগের নম্বর উল্লেখ থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে লাইফ জ্যাকেট, রশি, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ইত্যাদি সহজলভ্য করতে হবে। জরুরি উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।

ট্যুর অপারেটরদের জবাবদিহিতা : ট্যুর অপারেটরদের জন্য নিরাপত্তা প্রোটোকল তৈরি করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। প্রশিক্ষিত ও স্থানীয় অভিজ্ঞ গাইড নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। গাইডদের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

যোগাযোগ ও উদ্ধার ব্যবস্থার উন্নয়ন : দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। জরুরি উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য একটি সমন্বিত হেল্পলাইন চালু করতে হবে, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে। স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে যাতে দ্রুত উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা যায়।

স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা : স্থানীয় পাহাড়ি সম্প্রদায় এবং পর্যটকদের গাইড ও সহায়তাকারী হিসেবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাদের স্থানীয় পরিবেশ এবং ঝুঁকি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকে। তাদেরকে সচেতন করে প্রথম সাড়াদানকারী হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা গেলে পাহাড়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
লেখা : মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম, বান্দরবান