চিনামাটির পাহাড় ও নীল পানির লেক বিরিশিরি

abc

লেখা : রোহান মাহমুদ

পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্য্য আর আদিবাসীদের আচার-অনুষ্ঠানের কথা বললেই সবার চোখে ভাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু এই বহুল আলোচিত এলাকার বাহিরেও আমাদের দেশে আরো কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। যা অনেকের কাছে অজানা, কিঞ্চিত দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা অজ্ঞাত কারণে। আজ আমরা পরিচিত হবো তেমন একটি স্থানের সাথে, যেখানে একদিকে রয়েছে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য, অন্যদিকে সেখানকার আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনযাত্রা, যা আপনাকে আকৃষ্ট করবে।

সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগত বলতে আদতে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। একদিন প্রধান দেবতা তাতারা-রাবুগা মনস্থির করলেন পৃথিবী সৃষ্টি করবেন। নিজ ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য সহকারী দেবতা নন্তু-নপান্তুকে মনোনীত করলেন। নন্তু-নপান্তু একজন স্ত্রীলোকের বেশে পৃথিবী সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করলেন। সঙ্গ ও সহযোগিতা দিল সহকর্মী ‘মাচি’। 

প্রথমে নন্তু-নপান্তু পানির উপর বিছানো মাকড়সার জালে আশ্রয় নিলেন। হাতে ছিল তাতারা-রাবুগার কাছ থেকে পাওয়া এক মুঠো বালি। কাজটা শুরু হলো। হাতের বালি দিয়ে পৃথিবীর আকার দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বালিকে একত্র করে আটকে রাখাটা অসম্ভব। আটকে রাখতে হলে প্রয়োজন একটু কাদামাটির। নন্তু-নপান্তু কাদা মাটির জন্য কাঁকড়া আকৃতির অতিকায় এক প্রাণীকে পানির নিচে পাঠালেন।

কাঁকড়া যখন মাটি তুলে আনতে যাবে; ঠিক তখনই মাটির নিচের অধিবাসীরা তাকে মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলে। শেষ অব্দি সেই কাঁকড়া পানির নিচেই মারা যায়। এদিকে বিলম্ব দেখে নন্তু-নপান্তু ব্যাকুল ও শংকিত হয়ে পড়লেন। রহস্য উদ্ধারের জন্য তাঁর আরেক সহকর্মী ‘নচি’-কে প্রেরণ করলেন। সেইসাথে কাদামাটি আনার দায়িত্ব দিলেন। পানির নিচে গিয়ে নচি মৃত কাঁকড়াকে দেখতে পেলো। 

নচি মাটি নিয়ে ফেরার পথে দেবতা ‘ডুমারু চাংমারু’-এর স্ত্রী ‘চিরিমিট’-এর রূপে সম্মোহিত হয়ে যায়। নিজের দায়িত্ব এবং নন্তু-নপান্তুর কথা ভুলে বসে। দেবতা ডুমারু চাংমারু এসব দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে উঠলো। পরিণামে চোখ আর মাথা ব্যতীত নচির সারা শরীর মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলো।

নচির দুরবস্থা দেখে আদেশ বাহক ভৃত্য ‘মিসি’ হন্তদন্ত হয়ে খবরটা পৌছে দেয় নন্তু-নপান্তুর কাছে। আগাগোড়া শোনার পর নন্তু-নপান্তু মাটি আনার জন্য তাঁর প্রধান দেহরক্ষী ক্ষমতাধর নারেংসিকে নিযুক্ত করলেন। এবার আর ভুল হলো না। দিন-তারিখ পূর্ণ হলে সৃষ্টি করা হলো পৃথিবী। 

পৃথিবী বলতে দুই ধরনের পাথরের স্তূপ তৈরি হলো। বড় আকৃতির পাথর ‘মজার’ এবং ছোট আকৃতির পাথর ‘ডিনজার’। এছাড়া তখনো পৃথিবীর উপরিভাগ খুবই নরম। বসবাস দূরের কথা, হাঁটাহাঁটির জন্যও উপযোগী হয়নি। নন্তু-নপান্তু প্রধান দেবতা তাতারা-রাবুগার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন।

প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। তাতারা রাবুগা আকাশে সূর্য আর চন্দ্র এবং জমিনে বাতাস দিলেন। আলো আর বাতাসের স্পর্শে পৃথিবীর উপরিভাগ শক্ত আর কঠিন হয়ে উঠতে শুরু করলো। তাতারা-রাবুগা পৃথিবীকে রিংকিং বা পেটিকোট দান করলেন। সাথে দিলেন মেঘের তৈরী পাগড়ি। মাথায় সৌন্দর্যের জন্য দান করলেন আমফাং, রিসিক, প্রাপ ও বললেং গাছের মূলের ন্যায় চুল। 

প্রাণীদের মধ্যে তাতারা রাবুগা প্রথমে লেজহীন বানর সৃষ্টি করলেন। তার দায়িত্ব ছিল বিকট আওয়াজের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে সজাগ ও সচল রাখা। এরপর হনুমান ও বাদামি রঙের বানর জন্ম নেয়। পরে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের প্রাণী। জলচর প্রাণীদের মধ্যে সবার আগে বিশালাকার ব্যাঙ সৃষ্টি হলো। তার কাজ ছিলো, বিকট শব্দের মাধ্যমে আকাশে মেঘের আগমন বার্তা ঘোষণা করে দেওয়া। তারপরের দফায় তৈরি হলো মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী।

পৃথিবী সৃষ্টির পর মাটির নিচে অনেক পানি থাকলেও উপরে পানি ছিল না। তাতারা রাবুগা শুষ্ক ধরণীতে আনলেন নদীর প্রবাহ। আকাশ থেকে পানি বর্ষণের জন্য বৃষ্টির দেবী নরে-চিরে-কিমরে-বকরে নিয়োজিত হলেন। সাথে বজ্রের দেবতা গোয়েরাকেও পাঠানো হলো। তাতারা-রাবুগা তার সকল সহকারীকে সামনে ডাকলেন এবং পরামর্শ করলেন। সৃষ্টির সেরা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল। 

দেবী সুস্মিকে প্রথম মানব-মানবীর জন্য স্থান নির্বাচন করতে পৃথিবীতে পাঠানো হলো। প্রথম মানব-মানবীর নাম ছিলো শানী এবং মুনি। তাতারা-রাবুগার আদেশে নন্তু-নপান্তু প্রাচ্যের (তিব্বতের আশে পাশে কোথাও) আমিতিং-আফিলজাং নামক স্থানে আদি মানব-মানবী শানী এবং মনিকে প্রেরণ করেন। এই প্রথম জুটি থেকেই জন্ম নেয় গানচেং এবং দুজং। 

তখনো পৃথিবীতে খাবার বলতে কিছু নেই। গাছের ফল, বনের পশু-পাখির মাংস খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো। তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনেই জঙ্গল কেটে ভূমি চাষ করে থিতু হলো। পৃথিবীতে প্রথম ভূমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করেছে বনজাসকো এবং তার স্ত্রী জানেগানদো। শিকারজীবন থেকে তারাই প্রথম কৃষি সভ্যতার সূচনা করে। দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কৃতজ্ঞতা হিসাবে উৎপাদিত ফসলের কিছু অংশ উৎসর্গ করে তাদের নামে। সেই থেকে জন্ম নেয় ধর্মচর্চার নতুন উদাহরণ। এই জুটির বংশধরেরাই ‘গারো’ উপজাতি নামে পরিচিত এবং এদেরকে নেত্রকোণার আদিম অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রিয় পাঠক, আমরা কথা বলছি বাংলাদেশের কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মস্থান নেত্রকোণা জেলা এবং কেন্দুয়া উপজেলা নিয়ে। 

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার উপজেলার কুতুবপুরে মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শুধু হুমায়ূন আহমেদই নন, কাকতালীয়ভাবে কেন্দুয়া উপজেলায় প্রত্যেক প্রজন্মেই জন্ম গ্রহণ করেছেন অজস্র কিংবদন্তি। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি কঙ্ক, মৈয়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে, প্রখ্যাত লোক গায়ক ও সংগ্রাহক মনসুর বয়াতি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক মাস্টার দা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নরেশ রায়, প্রখ্যাত মরমী বাউল সাধক ও গীতিকার জালাল উদ্দিন খাঁ-সহ আরো অনেকে। 

নেত্রকোণার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার লোকমুখে প্রচলিত আছে, সোমেশ্বর পাঠকের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের রাজা জানকি নাথের স্ত্রী কমলা দেবি ছিলেন আদতে বিদ্যার দেবি সরস্বতীর অবতার। তিনি নিজের জীবনকে স্বেচ্ছায় বলি দিয়েছিলেন একটি দিঘীতে। কাকতালীয়ভাবে, তাঁর বলিদানের পর থেকেই যুগে যুগে বিভিন্ন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছে এই এলাকায়। যারা তাঁদের মেধা দিয়ে আলোকিত করেছেন সমগ্র জাতিকেই। 

তবে কি বলিদানের গল্পটি সত্য? আসলেই এর সাথে কোনো যোগসাজশ আছে অতিপ্রাকৃত কিছুর? প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। আপাতত মুখরোচক আলোচনা হয়ে থাকুক আমাদের মাঝে। কমলা দেবির বিস্তারিত বৃত্তান্তে আসছি পরে।

প্রাচীন ঐতিহ্যে টই-টুম্বুর ও ঐতিহাসিক বিচিত্র ঘটনার সম্ভারে গর্বিত ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্গত নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস। বিভিন্ন তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় স্পষ্টত প্রমাণ করে যে, সাগর বা সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠায় এ অঞ্চলটি গারোদের বসবাসের যোগ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল।

গারো পাহাড়ের পাদদেশ লেহন করে এঁকেবেঁকে কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, গোরাউৎরা নদীসহ অন্যান্য শাখা নদী নিয়ে বর্তমান নেত্রকোণা জেলার জলধারার উদ্ভব। ৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে জাপ্পা জালিমের নেতৃত্বে গানচেং এবং দুজং এর বংশধরদের আগমন ঘটে নেত্রকোণায়। প্রথমে তারা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বসতি স্থাপন করে।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এ অঞ্চল গুপ্ত সম্রাটগণের অধীন আসে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, গুপ্তযুগে সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ এ অঞ্চলসহ পশ্চিম ময়মনসিংহ কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। পরবর্তীতে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের তাড়নায় ধীরে ধীরে গারোরা পাহাড়ের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, গারো পাহাড়ের নামকরণ গারোদের নামানুসারেই হয়। 

৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরাজ শশাংকের আমন্ত্রণে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ যখন কামরূপ অঞ্চলে আসেন, তখন পর্যন্ত নারায়ণ বংশীয় ব্রাহ্মণ কুমার ভাস্কর বর্মণ কর্তৃক কামরূপ রাজ্য পরিচালিত ছিল। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরাংশে পাহার মুল্লুকে বৈশ্যগারো ও দুর্গাগারো তাদের মনগড়া রাজত্ব পরিচালনা করতো।

১২৮০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে মাঘ মাসের শীতকালীন অবসরে ভারতের কান্যকুব্জ থেকে একদল সাধু বেরিয়েছিলেন তীর্থ ভ্রমণে। বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুড়তে ঘুড়তে একসময় তারা উপস্থিত হন গৌহাটির নিকটস্থ পাহাড়ে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দিরের পূণ্যপীঠে। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর নদীর তীরে বিগ্রহলক্ষ্মী নারায়ণজীর আবাসে আশ্রয়গ্রহণ করেন এবং সেখানে মগ্ন হন ঈশ্বর আরাধনায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। নিরব পাহাড়ি পরিবেশ তাদেরকে বেশ প্রশান্তি দিচ্ছিল। 

হঠাৎ একদিন একদল দরিদ্র ধীবর সেখানে উপস্থিত হয়ে সাধুদের জানালেন যে ‘পাহাড় মুল্লুকে’ বৈশ্যগারো নামে এক দুর্ধর্ষ ও অত্যাচারী রাজা তাদের উপরে ক্রমাগত নির্যাতন করে চলেছে । এহেন অবস্থা থেকে তারা পরিত্রাণ চায়। ধীবরদের মুখে এ নির্যাতনের কাহিনী শুনে এক প্রবীণ সাধুরমনে দয়ার উদ্রেক হয়। তিনি তারকনিষ্ঠ সাধু সোমেশ্বর পাঠককে বলেন, সোমেশ্বর তুমি ‘এই অরণ্যভূমি অধিকার করে এখানে একটি রাজ্য স্থাপন কর! তাতে তোমার অভীষ্ট সিদ্ধি ও ধীবরদের মঙ্গল হবে।‘ 

জ্যোষ্ঠ সাধুর নির্দেশকে শিরোধার্য ভেবে আরও কয়েকজন সন্ন্যাসীকে নিয়ে সোমেশ্বর পাঠক থেকে গেলেন নিবির পাহাড়ি অরণ্য এ জনপদে। আর বাকি সাধুরা চলে গেলেন পূর্বের গন্তব্যে। তারপর সোমেশ্বর পাঠক অন্যান্য সহচর ও ধীবরদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন এবং অত্যাচারী বৈশ্যগারো রাজাকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন এক রাজ্য। যার নাম দেন ‘সুসং রাজ্য। 

রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর রাজ্যের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলধারায় প্রবাহিত পাহাড়ি নদীটির নাম দেন ‘সোমেশ্বরী’। সুসং রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এক বিরানভূমিকে করা হয় রাজধানী। রাজধানীর নাম রাখা হয় দুর্গাপুর। বর্তমানে সেই দূর্গাপুর জনপদটিই নেত্রকোনা জেলার সুসং দূর্গাপুর উপজেলা নামে পরিচিত।

সুসং রাজ্যের প্রথম রাজা সোমেশ্বর পাঠকের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে রাজা হন তার বংশধরেরা। তার বংশধরদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য রাজা ছিলেন রাজা রঘুনাথ সিংহ। সুসঙ্গ রাজবংশের রাজাগণের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক পরাক্রমশালী। ১৫ শতকের শেষ দিকে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ বিয়ে করেন কমলা দেবী নামে এক সুন্দরী নারীকে। 

রাণী কমলা দেবী যেমন রূপেগুণে সুন্দরী ছিলেন, তেমনি ছিলেন পরম ধার্মিক। রাজা জানকি নাথও ছিলেন পরম প্রজা হিতৈষী। রাণীর গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। পুত্রের নাম রাখা হল রঘুনাথ। রাজা জানকি নাথ প্রজাদের মঙ্গলার্থে পানির অভাব নিবারণের জন্য একটি পুকুর খনন করেন কিন্তু পুকুরে আর পানি উঠল না। রাজা মহা চিন্তায় পড়লেন।

কথিত আছে, একরাতে রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন রাণী কমলা দেবী যদি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজো দেন তাহলে পুকুরে পানি উঠবে। রাণী কমলা দেবী প্রজাদের মঙ্গলার্থে পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজোয় বসলেন। সহসা চারিদিক দিয়ে পানি উঠতে শুরু করল। পানি রাণী কমলা দেবীকে স্পর্শ করল। রাণী কমলা দেবী উঠে দাঁড়ালেন এবং কড়জোড়ে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পানি বেড়েই চলল, পানি বাড়তে বাড়তে হাঁটু পেরিয়ে কোমরে পৌঁছালো। রাজা জানকি নাথ অস্থির হয়ে গেলেন। রাণীকে পাড়ে ভেড়ার জন্য চিৎকার দিতে শুরু করলেন। ততক্ষণে পানি রাণীকে ডুবিয়ে ফেলল। রাণী আর পানি থেকে উঠে এলেন না। পানিতে একাকার হয়ে মিশে গেলেন। 

রাজা জানকি নাথ এ দৃশ্য দেখে বিচলিত হলেন। স্থানীয়দের মাঝে এও কথিত, কমলা রাণী ছিলো সরস্বতী দেবীর অবতার। সরস্বতী ছিলেন বিদ্যার দেবী। পবিত্রভূমির কল্যাণে দেবীর এই আত্মত্যাগের পর থেকে কাকতালীয়ভাবে এই জেলায় যুগে-যুগে, প্রত্যেক প্রজন্মে কিংবদন্তি মানুষজন জন্মগ্রহণ করেছেন।

রাজা জানকি নাথ অস্থির হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে শুরু করলেন। কয়েক মাসের শিশু সন্তান রঘু যে মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কিছুই খায় না। রাজা জানকি নাথ এই চিন্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি এক রাত্রে স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন, শিশু সন্তান রঘুকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসলে রাণী কমলা দেবী তাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। তবে শর্ত যে, রাজা কখনো রাণীকে স্পর্শ করতে পারবেন না। রাজা জানকি নাথ গভীর রাতে শিশু সন্তানটিকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসতেন আর রাণী কমলা দেবী তার সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়ে আবার পানিতে চলে যেতেন।

এই দৃশ্য রাজাকে খুব যন্ত্রনা দিত। একদিন মধ্যরাতে যখন রাণী কমলা দেবী তার সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন তখন রাজা জানকি নাথ কমলা দেবীকে ধরার জন এগিয়ে গেলেন। রাণী রাজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। পরে রাজা রাণীর চুলে ধরলেন কিন্তু রাণীকে আর রাখতে পারলেন না। রাণী পানিতে নেমে পানির সাথে একাকার হয়ে গেলেন। শিশু সন্তানটিকে তিনি আর দুধ খাওয়াতে এলেন না। রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন যদি আর ৭ দিন বুকের দুধ খাওয়ানো যেত তাহলে শিশু সন্তান রঘু দিক বিজয়ী, প্রতাপি বীর হিসাবে গণ্য হত। তবে তারপরেও রঘুনাথ এর জীবন যথেষ্ট ঘটনাবহুল ছিলো। এতোটাই, তিনি সম্রাট আকবরের নিকট হয়ে 'মহারাজা' উপাধি পেয়েছিলেন!

দুর্গাপুর উপজেলা সদর হতে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কমলা রাণী দিঘী। দিঘীটি সাগর দিঘী নামে পরিচিত। দিঘীটি পুরোপুরি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ পশ্চিম পাড় এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। উপজেলা পরিষদ থেকে রিক্সা বা মোটর সাইকেলে বিরিশিরি ব্রীজ পার হয়ে বামপাশে গুজরীকোণার পাকা রাস্তা দিয়ে ১.৫ কিলোমিটার পরে কমলা রাণী দিঘীর পাড়।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার পালাবদল এবং মুঘলদের ক্ষমতা দখলের গল্পটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয় এবং মুখরোচক। যেহেতু মিথ নিয়ে লিখতে বসেছি, সে ঘটনাবহুল গল্প আরেকদিন এর জন্য তোলা থাকলো।

চন্দ্র কুমার দে সংগৃহীত এবং ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত বিশ্ব নন্দিত গ্রন্থ ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশের পর থেকে পূর্ব ময়মনসিংহকে অনেক গবেষক মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চল বলেও চিহ্নিত করে থাকেন। এই ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত করা হয়-উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিণে মেঘনা, যমুনা সঙ্গমস্থল, পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং পূর্বে সুরমা কুশিয়ারা নদী। এই মৈমনসিংহ গীতিকা অঞ্চলের লোক সাহিত্য সংস্কৃতি, ভোগলিক ও ঐতিহাসিক বিচার-বিশ্নেষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো নেত্রকোণা। প্রায় সাড়ে তিশ বছর পূর্বে কবি দ্বিজ কানাই (কেন্দুয়া উপজেলা) মহুয়ার পালা নামে একটি পালা গান শুরু করেন। কবি চন্দ্র কুমার দে ১৯২১ সালে ৯ মার্চ মহুয়ার পালা গানটি সংগ্রহ করেন।

মৈয়মনসিংহ গীতিকার মূল চরিত্র নদের চাঁদ ও মহুয়া। কথিত আছে যে, নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্ছাজাইল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে। সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপর পক্ষে রূপবতি মহুয়া বেদে সরদার হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোণার কাঞ্চণপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। জানা যায়, বেদে মহুয়াও এক সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। 

বেদেরা ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলতো ও হাট বাজারে পাড়ায় সাপের খেলা দেখাত। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসেন তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করেন। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরদার হুমরা বেদে। এক দিন নদের চাঁদ মহুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যান। 

এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সরদার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে বলে ‘‘যাও নদের চাঁদকে মেরে ফেল’’। বিষলক্ষা ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যান। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌছে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং মাটিতে ঢলে পড়েন। 

প্রণয় পিয়াসী নদের চাঁদ, মহুয়ার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজ জীবন আত্মহুতি দেন। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্মত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। আজও সেই প্রেমের অমর কহিনী লোক মুখে মুখে বিরাজমান।

হুমায়ূন স্যারের পিত্রালয়ের দর্শনীয় স্থান-সমূহ
বৈচিত্র্যময়! নৃ-গোষ্ঠীদের সংস্কৃতি, কংশ-টেপা-সোমেশ্বরীর সৌন্দর্য আর দূরে আকাশে হেলান দিয়ে গম্ভীর গারো পাহাড়ের ধ্যানমগ্ন প্রতিকৃতি যে কারো মন কেড়ে নেয়। সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে।

দেশের একমাত্র চিনামাটির পাহাড়, সাদামাটির পাহাড় এবং নীল পানির লেক, বিরিশিরি
প্রথমেই আপনি চলে যেতে পারেন সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে বিজয়পুর, যেখানে আছে বাংলাদেশের একমাত্র চীনামাটির খনি, আছে বিখ্যাত নীল পানির লেক, ছোটবড় অসংখ্য পাহাড় ইত্যাদি। দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের আড়াপারা গ্রামে এই চীনা মাটির পাহাড় দৃষ্টি কাড়ে দর্শনার্থীদের। চীনা মাটির পাহাড় এবং সবুজ-নীল স্বচ্ছ জলের লেক মূলত একই জায়গায়। 

পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় নানান জায়গায় বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেখানেই পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে স্বচ্ছ লেক। সেখানে মূলত লেক তিনটি। একটি বেশ বড়। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ জলাধারগুলো দেখতে চমৎকার লাগে। আর সেটাতে অনেক পর্যটকই লম্ফঝম্ফ মেরে গোসল সেরে নেন; যদিও এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। 

এছাড়া ঘুরতে আসা অনেকেই দলবেঁধে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে। সেখান থেকে পুরো গ্রাম দেখা যায়। শসার পাড় এবং বহেরাতলী গ্রামে সাদা মাটি অবস্থিত। এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধার গুলো দেখতে অত্যন্ত চমৎকার।

বিজয়পুর বিজিবি কাম্পে যেতেও ভুলবেন না। ফেরার পথে দেখে আসবেন উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, মোহনগঞ্জের ডিঙ্গীপোতা হাওর। এছাড়া আপনি ভবানিপুর, নলুয়াপাড়া, গোপালপুর, লক্ষিপুরের পাহাড়গুলো দেখে আসতে পারেন। বাইক দিয়ে এসব জায়গায় যেতে দুর্গাপুর থেকে ১৫/২০ মিনিট লাগে।সোমেশ্বরী নদী স্বচ্ছ পানি আর ধুধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। এর বালুচরে দাঁড়ালে আপনি উদাস হতে বাধ্য। এই নদীর প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা ট্রলার নিয়ে রানিখং গির্জার পাশ দিয়ে বিজয়পুর বিজিবি কাম্প এর দিকে যেতে হবে, পাহাড় ও নদীর আসাধারন যুগল সৌন্দর্য আপনাকে বিস্মিত করবেই।

রানী খং মিশন
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে কাল্লাগড়া ইউনিয়নের উত্তর পূর্ব সীমান্তে সোমেশ্বরী নদীর কোল ঘেঁষেই পুরো মিশনটি একটি উচু পাহাড়ে অবস্থিত। ১৯১০ সালে এ মিশনটি স্থাপিত হয়। ইহা খ্রীষ্টিয় ক্যাথলিক ধর্মপল্লী। রাণীখং নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তী আছে যে, এ অঞ্চলে ‘‘খং-রাণী’’ নামে এক রাক্ষস বাস করত। 

গারো আদিবাসীরা এই রাক্ষসটিকে হত্যা করে এ অঞ্চলে শান্তি এনেছিল। যার ফলে এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল রাণীখং। রানীখং নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত বলে এ মিশনটির নাম রানীখং মিশন। প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমি রাণীখং মিশন। পাহাড় চুড়ায় গড়ে উঠা মিশনটির পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পাহাড়ী নদী ‘সোমেশ্বরী’। 

মিশনটির সম্মুখে বিস্তির্ণ সাদা সিলিকা বালি। ছোট বড় সারি সারি টিলা-পাহাড় মিশে গেছে দিগন্ত জুড়ে। পা বাড়ালেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। এখান থেকেই উপভোগ করা যায় পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি খেলা আর নীলিমায় ভেসে যাওয়া বনবিহার। নৌকাযোগে সরাসরি রাণীখং মিশনে পৌঁছানো যায়। এছাড়া রিক্সা বা মোটর সাইকেলে অর্ধ-কাচা ও অর্ধ-পাকা রাস্তা দিয়ে রাণীখং পৌছা যায়। গির্জার উপর থেকে ভারতের পাহাড়গুলোকে দারুণ দেখা যায়। বহুদূর বিস্তৃত সোমেশ্বরী নদীকে মন ভরে দেখতে পাবেন এখান থেকে।

বিজিবি ক্যাম্পের ডান দিকে চলে গেলেই দেখা মেলে নদীর। এখান থেকে নদীতে ঘোরাঘুরির জন্য ঘণ্টা হিসেবে ছোট সাইজের ইঞ্জিন চালিত নৌকা পাওয়া যায়। যা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ জলে। নদীর অপরপাশে ভারত সীমান্ত পর্যন্তও যাওয়া যায়।

সুসং রাজ্যের রাজবাড়ী ‘দু’আনি বাড়ি’
১৩ শতকের শেষ অবধি টিকে ছিলো সোমেশ্বর পাঠকের বংশধরদের রাজত্ব। রাজত্বের শেষ দিকে এসে রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ সংকটে ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সুসং রাজ্য। তৈরি হয় ৪টি রাজবাড়ী। এরই একটি দু’আনি বাড়ি। দু’আনি বাড়ির প্রবেশ পথেই ২ পাশে মাটির কলস বসানো প্রধান ফটক। 

ফটক গলে ভেতরে ঢুকতেই ফটক বরাবর চোখে পড়বে কাঠের তৈরি নিপুণ কারুকার্যের নজরকাড়া বিশালাকৃতির ঘর। ঘরের সামনে টবে রাখা বাহারি রঙ-গন্ধের ফুলের বাগান। এখানেই একসময় রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য ইঁদারা ছিল। 

রাজবাড়ীর বাম দিকে রয়েছে ৩টি পূজামণ্ডপ। কাঠের কারুকার্যে ও রংয়ের অপূর্ব মনোরম মিশেলে তৈরি মণ্ডপগুলো চোখে এনে দেয় প্রশান্তি। প্রথম মণ্ডপুটি দেবী দুর্গার, দ্বিতীয়টি দেবী লক্ষ্মী ও কালীর এবং শেষটি কৃষ্ণের। এসব মণ্ডপে এখনো আশ্বিন মাসে বিশালাকারে দুর্গা পূজা হয়। বছরের ‍অন্যান্য সময়েও এখানে পূজা-পার্বন লেগেই থাকে।

পূর্বধলার পাগলপন্থীদের মাজার
লেটিরকান্দা গ্রামে পাগলপন্থীদের পারিবারিক কবর রয়েছে। সে কবরস্থানে পাগল পন্থিকরণ শাহ্, টিপু শাহ্, ছপাতি শাহ্ সহ তাঁদের বংশের অন্যান্যদের কবর রয়েছে। সে কবরস্থানের প্রাচীরটি বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল, যা এখনো দাঁড়িছে আছে। পাগলাপন্থীদের মুখরোচক গল্পটিও তোলা রইল।

রোয়াইল বাড়ির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন
নেত্রকোণা জেলার অন্তর্গত কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে কেন্দুয়া ঢাকা সড়ক হয়ে প্রায় ১৩ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে বেতাই নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত পুরার্কীতি কেন্দুয়ার রোয়াইল বাড়ী। ১৯৯২ খৃস্টাব্দে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কতৃক রোয়াইল বাড়িতে খনন কাজ পরিচালিত হলে বেরিয়ে আসে মসজিদ, দূর্গ, রাস্তা, পরিখা, কবরস্থান ও অনেক অট্টালিকা।

সাত পুকুর ও হাসানকুলী খাঁর সমাধি
আটপাড়া থানার রামেশ্বরপুর ও সালকি গ্রামে সাতটি পুকুর রয়েছে। বিশাল এ পুকুরগুলো অতি প্রাচীনকালে খনন করা বলে মনে হয়। বড় পুকুরের পশ্চিম পাশে হাসানকুলী খাঁর সমাধি। সে সমাধিটি কালো শিলা দিয়ে বাঁধানো। হাসানকুলী খাঁ ছিলেন একজন পুঁথি লেখক। তার পুঁখির সুত্র ধরে বিচার করলে এ পুকুর ও সমাধিটি মোঘলযুগের বলে ধরে নিতে হয়। এ ছাড়া শুনই গ্রামের প্রাচীন দূর্গ এখন বিলুপ্ত।

টংক শহীদ স্মৃতি সৌধ, দুর্গাপুর
বৃটিশ ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবীতে বৃহত্তর উত্তর ময়মনসিংহের কৃষকগণের সংগ্রাম কৃষক বিদ্রোহ ও টংক আন্দোলন নামে পরিচিত। আন্দোলনের প্রাণ শক্তিই ছিল আদিবাসী কৃষকগণ। তাঁদের এ মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা স্বরুপ সুসং দুর্গাপুরে এম.কে.সি.এম সরকারী স্কুলের পশ্চিম পার্শ্বে ৩২ শতাংশ জমির উপর টংক শহীদ স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়। এখানে প্রতি বছর ৩১শে ডিসেম্বর মহান নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কমরেড মনি সিং এর মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হয়। মনিমেলা নামে এ অনুষ্ঠান ৭দিন যাবৎ চলে।

উপজেলা পরিষদ হতে ছয় কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেড়াতলী গ্রামে চৌ-রাস্তা মোড়ে হাজং মাতা রাশমণি স্মৃতি সৌধ অবস্থিত। রাশমনি হাজং ছিলেন টংক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।

কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সুসং দুর্গাপুরে যাওয়ার এবং ফেরার জন্য সবচাইতে ভালো হবে ‘বলাকা কমিউটার’ ট্রেন অথবা নাইট কোচ বাস সার্ভিস এবং তৃতীয় অপশন আন্তঃনগর হাওর এক্সপ্রেস ট্রেন সার্ভিস ‘বলাকা কমিউটার’। ট্রেনে করে কমলাপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে সরাসরি জারিয়া-ঝাঞ্জাইল আসা যায়। সেখান থেকে সুসং দুর্গাপুর সদর মাত্র ১৩ কি.মি. । ‘বলাকা কমিউটার’ কমলাপুর থেকে ছাড়বে ভোর ৪.৪০ এ। এবং জারিয়া পৌঁছাবে সকাল ১০ টায়। আবার জারিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে দুপুর ১২ টায়। ঢাকা পৌছবে বিকাল ৫.৩০ এ। ট্রেনের টিকেট অগ্রিম দেয়া হয়না। ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্তে কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করতে হয়।

নাইট কোচ বাস সার্ভিসঃ ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সুসং দুর্গাপুরে উদ্দেশ্যে রাতে বেশ কিছু বাস ছেড়ে যায়। রাত ১২ টায় এবং একটায় মহাখালী টার্মিনাল থেকে নাইট কোচ ছেড়ে যায়। এই বাস আপনাকে ভোরে সুসং দুর্গাপুর নিয়ে নামাবে।

যারা ঝটিকা সফর করতে চান তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে নাইট কোচে দুর্গাপুর এসে তালুকদার প্লাজা/অগ্রণী ব্যাংকের সামনে থেকে সারাদিনের জন্য বাইক ভাড়া করে (ভাড়া ৮০০/১০০০) সবকিছু ঘুরে দেখে আবার নাইটকোচে ফেরত যাওয়া।

কোথায় থাকবেন :
সুসং দুর্গাপুরে থাকার জন্য ভাল মানের বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউস ও হোটেল আছে। ১ ও ২ বেডের রুম গুলোর ভাড়াও খুব হাতের নাগালে এবং খাবারের মানও ভালো। বিভিন্ন মান ও সুবিধা অনুযায়ী রুম ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। নিম্নে এদের নাম এবং কন্টাক্ট নাম্বার দেয়া হল-
জেলা পরিষদ ডাক বাংলা- ০১৫৫৮৩৮০৩৮৩; ০১৭২৫৫৭১৭৯৫
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী গেস্ট হাউজ। ফোন: ০৯৫২৫-৫৬০৪২; মোবাইল: ০১৮১৫৪৮২০০৬
ইয়ুথ মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন এর রেস্ট হাউজ- ০১৭১৬২৭৭৬৩৭
ওয়াইডব্লিউএমসি গেস্ট হাউজ: ০১৭১১০২৭৯০১। ওয়াইডব্লিউএমসি (YWCA) এর জন্য অমিতা সাংমা – ০১৭১২০৪২৯১৬
স্বর্ণা গেস্ট হাউস -০১৭১২২৮৪৬৯৮; ০১৭২৮৪৩৮৭১২
হোটেল সুসং- ০১৯১৪৭৯১২৫৪
হোটেল গুলশান – ০১৭১১১৫০৮০৭
হোটেল জবা – ০১৭১১১৮৬৭০৮; ০১৭৫৩১৫৪৬১৭
নদীবাংলা গেস্ট হাউজ – ০১৭৭১৮৯৩৫৭০; ০১৭১৩৫৪০৫৪২

References:
১) বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিক গবেষণা, ২য় খণ্ড, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, উৎস প্রকাশন