সীমান্ত-ঘেঁষে ২৩ কিলোমিটার হেঁটে চলা

বিয়ের পর এইটা ছিল আমাদের প্রথম ভ্রমণ। সাধারণত বিয়ের পর মানুষ রিল্যাক্স ট্যুরেই যায়। কিন্তু আমরা গেলাম হাইকিংয়ে। দুজনেরই রিল্যাক্স ট্যুর অপছন্দ হওয়াতে দ্বিতীয়বার আর ভাবতে হয়নি। ট্যুরমেট হিসেবে পাই কাছের ভাই-ব্রাদার ও বন্ধুদের।
অক্টোবর মাস তখন। সারারাত বৃষ্টি শেষে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে সিলেট শহর আমাদের স্বাগতম জানায়। বাস থেকে নেমেই দেরি না করে আগে থেকে ঠিক করা লেগুনা করে চলে যাই গোয়াইনঘাটের হাদারপার বাজারে। সেখানে নাস্তা শেষ করে আমরা নৌকায় করে বিছানাকান্দি যাই। সেখান থেকে মূলত আমাদের হাইকিং শুরু হয় জাফলংয়ের উদ্দেশে।
একপাশে ভারতের সুউচ্চ পাহাড়, আর আরেক পাশে নিজের দেশের সমতলে সবুজ ধানক্ষেতের হিমেল হাওয়া। কখনো প্রতিবেশী দেশের পাহাড়ের পাদদেশে হাঁটা, আবার কখনো মাছের ঘেরের পাড় দিয়ে।
গ্রামীন জনপথে এগিয়ে চলছি আমরা, পথে শরীর ভিজিয়ে নিলাম লক্ষ্মণছড়ার ঠান্ডা পানিতে। লক্ষ্মণছড়ার উৎপত্তি কিন্তু ভারতে পাহাড় থেকেই। ছড়া থেকে উঠে রাস্তা খুঁজে পেতে একটু কষ্টই হলো, যেতে হলো এক বাড়ির উঠান হয়ে।
এরপর অবশ্যই ভালোই রাস্তা, গ্রামীন মেঠো পথ। অবশ্যই নদীও পাড় হতে হলো। হাটু পর্যন্ত পানি থাকায় নৌকার দরকার হয়নি। যদিও একটু স্রোত ছিল, সবাই হাত ধরা ধরি করে পাড় হলাম।
নির্মল বাতাস গায়ে জড়িয়ে আমরা পৌঁছে যাই পান্থুমাই ঝর্ণার কাছে। সেখানেই আমরা দুপুরের খাবার খাই। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
খোলা সবুজ মাঠ, মাথার উপর মস্তবড় এক ফালি আকাশ আর ওই দূর থেকে পান্থুমাই ঝর্ণার কলকল ধ্বনি ভেসে আসছিল। দুপুরের খাবার শেষে আমরা সেখানেই কতক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। জায়গাটা আমাদের বেশ পছন্দ হইছিল।
আমাদের আবার হাঁটা শুরু হলো। আবারো নদী পাড় হতে হলো, এরপর একটা বাজার। একটু চায়ের বিরতি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি খাসিয়া পল্লির ভেতর দিয়ে।
ততক্ষণে টিমের অনেক সদস্য অবশ্য হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে অটোরিকশায় করে জাফলং চলে যায়। কিন্তু আমরা কয়েকজন মনস্থির করে নিয়েছিলাম, আমরা হেঁটেই শেষ করব পুরো পথ। রাস্তা ভুল করার কারণে আমাদের তিন/চারজনকে অবশ্য একটু বেশিই হাঁটতে হয়েছিল।
অবশেষে যখন আমরা জাফলং পৌঁছাই তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু, এইদিকে চারদিকে অন্ধকারও নেমে আসছিল। আমরা নৌকায় পার হয়ে জাফলং জিরো পয়েন্টে আসার জন্য বৃষ্টির মধ্যেই অপেক্ষা করছিলাম। ওইদিকে নৌকারও সংকট চলছিল।
সবাইকে ভিন্ন ভিন্ন নৌকায় তুলে দিয়ে আমি, ফয়সাল, সাব্বির ভাই, স্বাধীন উঠি শেষ নৌকায়। শেষ নৌকা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভীড় অনেক বেশি। তার ওপর বৃষ্টি কমার নাম নেই। নৌকায় পানি ছুঁইছুঁই অবস্থা। আমি সাঁতার জানি না, ভয়টাও পাচ্ছিলাম ভীষণ। ফয়সাল বারবার বলতেছিল, আমি আছি কোনো ভয় নেই।
তবুও নিজের বুকের মধ্যে একটা কম্পন তো চলছিলই। তার মধ্যে ঘটলো আরেক বিপত্তি। নৌকার একদম শেষ যাত্রী যারা ছিল, তারা মূলত ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে বেশ বড় একটা পরিবার। ওদেরকে শুরু থেকেই পেছনে যাওয়ার জন্য বলার পরও ওরা একদম নৌকার সামনের দিকটাতেই বসে ছিল। যে ভয়টা পাচ্ছিল সবাই সেটাই হলো।
নৌকার সামনের দিক থেকে পানি ঢুকে পড়ার মতো অবস্থা দেখেই সাব্বির ভাই এক লাফে নৌকার পেছনে চলে গেলেন, সাথে আরো কয়েকজন। এতে কিছুটা ব্যালেন্স হলো, আর মাঝির দক্ষ হাতের চেষ্টা।
এই ব্যাপারটা এত তাৎক্ষণিকভাবে ঘটছিল যে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই চিৎকার করছিল।
দিনের মতো আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বড় কোনো বিপদ থেকে। পুরো ট্যুর-জুড়ে এই একটাই বাজে অভিজ্ঞতা হলো।
জিরো পয়েন্টে যখন পৌঁছাই ততক্ষণে টিমের সবাই ভেজাকাক। বৃষ্টি থামার তখনও কোনো নাম গন্ধ নেই। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই চলে গেলাম সিলেট শহরে। ততক্ষণে রাত ৯টা। সবাই ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার শেষ করে, আড্ডা দিতে দিতে বাস চলে এলো। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ঢাকায় ফিরলাম। সব মিলিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতা যুক্ত হলো আমরা ভ্রমণ খাতায়।