সীমান্ত-ঘেঁষা ২৩ কিলোমিটার হেঁটে চলার অভিজ্ঞতা যেমন ছিল

বিছানাকান্দি টু জাফলং, অনুমান করুন তো আপনি এই পথটা হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেবেন! আসলেই এই দুঃসাহস দেখানোর জন্য আমার মন এবং মস্তিষ্ক একটুও ভাবেনি।
গৃহত্যাগী গ্রুপে যখন দেখেছি বিছানাকান্দি টু জাফলং হাইকিং ট্যুরের বুকিং চলছে, তখনই বুকিং কর্নফাম করি। বুকিং দেয়ার পর অনিশ্চয়তায় পরে যাই আসলেই কি যাওয়া হচ্ছে?
কারণ অফিস থেকে ছুটি নেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই এবং অফিসের বস আবার ফিল্ড ভিজিটে যেকোনো সময় আমার এখানেও আসতে পারেন। এই দোটানার মধ্যে পরেও দিন এগোতে লাগলো।
অবশেষে ২২ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার চলে এলো। ট্যুর শুরু ঢাকা থেকে, কিন্তু আমি তো বগুড়ায়। বগুড়া থেকে দুপুরে গাড়িতে ঢাকা। এদিকে ভাই এবং কাকু (যে যেটা ধরে নেবেন সেটাই) জাহানুর রহমান খোকন তিনিও এই ট্যুরে বুকিং দিয়েছে আমার কথায়। তিনিও যাবেন। তিনি আগের রাতে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা পৌঁছেছেন।
তার কারণে আগ্রহটা আরো বেশি ছিল। ঢাকা পৌঁছে বন্ধুবর কিরণের মিরপুরের বাসায় উঠে গোসল শেষে মিরপুর ১০ থেকে মেট্রোতে মতিঝিল। সেখানে কাকু আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন, সাথে আরো একজন জয়েন করলেন জাকির ভাই। তিনজন মিলে সেখান থেকে সায়দাবাদ এরপর, রাত ১০টায় সিলেটের উদ্দেশে রওনা।
ও হ্যাঁ, গৃহত্যাগী কিন্তু এবার এসি বাসে নিয়ে গেছে। যদিও কথা ছিল ননএসি বাসে।
যাত্রা শুরু হলো। আমাদের গাড়ি চলছে...
সিলেট পৌঁছানোর ৫ কিলোমিটার রাস্তার আগেই গাড়ির পেছনের একটা টায়ার নষ্ট হয়ে বিকট শব্দ শুরু হলো, গাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে উঠলো গাড়ি থামান, সকালের কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল সবার। হেলপার নেমে চাকা চেক করে ওই অবস্থায় আমরা সিলেট পৌঁছালাম। পানশি রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা শেষে আমাদের সিলেট ট্রিপের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।
লেগুনা করে প্রায় ২ ঘণ্টার এবরোথেবরো রাস্তা পেড়িয়ে আমরা পৌঁছালাম নৌকা ঘাটে। নৌকা করে বিছানাকান্দি। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে হাত বুলিয়ে শরীর জুড়িয়ে নিলো সবাই। নৌকা চলছে আর দূরের ওই পাহাড় কাছাকাছি আসছে। আমরা বিছানাকান্দি পৌঁছালাম এবার আমাদের হোস্ট এবং গৃহত্যাগী এডমিন ফয়সাল ভাই ব্রিফিং দিলেন কিভাবে কী করতে হবে।
সীমান্ত এলাকা, আর আমরা যেহেতু সীমান্ত ঘেঁষে হেঁটে চলবো। তাই কোনোভাবেই যেন নোম্যান্সল্যান্ড অতিক্রম না করি। যাত্রা শুরু হলো বিছানাকান্দি ঘুরে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম লক্ষ্মণছড়া, ভারত থেকে বয়ে আশা ঝর্ণার স্বচ্ছ শীতল পানি এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মনের সকল ব্যথা এবং শরীরের সকল ক্লান্তি মুছে নিলো নিমিষে।
আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম, ততক্ষণে দুপুর পেরিয়ে গেছে। এডমিন সাহেব বললেন, আর ৩০ মিনিট হাঁটলে আমরা পান্থমই পৌঁছাবো, ঝর্ণা দেখতে দেখতে সেখানে দুপুরের খাবার। ২ ঘণ্টা হাঁটার পরও সেই ৩০ মিনিট শেষ হয় না। তবুও কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটছি সবাই, কারণ আমরা জেনেই এসেছি ২৩ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। সবাই ক্লান্ত একটু বসে জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। অবশেষে আমরা পান্থমই পৌঁছাই। প্রকৃতি আমাদের স্বাগত জানায় ঝরনা কলকল শব্দে।
ঝর্ণার রূপ দেখতে দেখতে দুপুরেট খাবার শেষ করি। ততক্ষণে আমরা ১৯ কিলোমিটার হেঁটেছি, কখনো নদী পেরিয়ে কখনো, সমতল পথ, কখনো পাহাড়, কখনো গ্রামের ভেতর দিয়ে। খাওয়া শেষে উদ্দেশ্য জাফলং।
আমাদের হাঁটা শুরু হয়, অবশেষে সময় বিবেচনা করে আমরা কিছুটা পথ অটোরিকশায় যাই। যাত্রা পথে চোখে পরে সংগ্রাম পুঞ্জি, খাসিয়া পল্লি, প্রতাপ পুঞ্জি-সহ আদিবাসীদের গ্রাম। অবশেষে আমরা জাফলং পৌঁছাই, ততক্ষণে ঘড়ির কাটায় ৬টা অতিক্রম করেছে। সময়ক্ষেপণ না করে আমরা চলে যাই মায়াবী ঝর্নায়, গোসল করার ইচ্ছে থাকলেও সময় স্বল্পতা এবং মানুষের ভিড়ে তা হয়নি।
নৌকা করে জাফলং জিরো পয়েন্ট এসে ঝরনার শীতল পানিতে গোসল সেরে নেই্। এবং সেই সাথে সমাপ্তি হয় দীর্ঘ ২৩ কিলোমিটার পথের।
জীবনের এই ঠুনকো সময়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য হঠাৎ এমন একটা করে টুরের প্রয়োজন।
জীবন সুন্দর...!
আবার কোনো বৃহস্পতিবার এমন গল্প তৈরির উদ্দেশে বেড়িয়ে পড়বো অন্য কোনো পথে। সেই অবধি দোয়া এবং ভালোবাসায় রাখবেন।